অজানাকে জানতে আর অচেনাকে চেনার উদ্দেশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ৫ম ব্যাচের কয়েক বন্ধু মিলে স্বপ্ন দেখি ভারত ভ্রমণের। স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে আমরা নেমে পড়ি মাঠে। তারপর দীর্ঘ ছয় মাসের চেষ্টা আর পরিশ্রমের ফলে চলে আসে কাঙ্খিত সেই দিন। শুরু হয় আমাদের স্বপ্নযাত্রা। ২১ জন সহপাঠী ও দু’জন বিভাগীয় শিক্ষককে নিয়ে ভারতের উদ্দেশে যাত্রা শুরু হয় আমাদের।
কলকাতা পৌঁছেই ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দেই বিছানায়। সফরের প্রথম রাতটা কোনো আড্ডাবাজিতে নয়, কোনো দুষ্টুমিতে নয় নিরেট বিশ্রামেই কাটে আমাদের। পরদিন সকালে যাত্রা শুরু হয় ঐতিহাসিক শহর আগ্রার উদ্দেশে। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে আজমীর এক্সপ্রেসে করে আগ্রার উদ্দেশে পথ ধরি। দীর্ঘ ২৯ ঘণ্টার ট্রেন যাত্রা শেষে সন্ধ্যায় যখন আগ্রায় পৌঁছলাম সবার চোখে-মুখে তখন রাজ্যের ক্লান্তি।
ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহে সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম কখন ভোরের আলো ফুটবে আর চোখ শীতল করব আগ্রার সৌন্দর্য দেখে। সকালের আলো ফুটতেই যথারীতি আমরা প্রস্তুত তাজমহল দর্শনে। শাহজাহানের অমর প্রেমের এ নিদর্শনে ঢুকেই মুহূর্তের মধ্যে ঢাকা থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে আগ্রা টানা চারদিন ভ্রমণের ক্লান্তি উধাও হয়ে গেল। মনে হল পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটিকে যদি না দেখা হতো তাহলে এটি সম্পর্কে অনেক বিষয়ই হয়তো অবিশ্বাস্যই থেকে যেত। সকালের মিষ্টি পরিবেশে সূর্যের আলো পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাজমহলের রঙ পরিবর্তন হচ্ছিল। কখনও হলদেটে, কখনও সোনালি আবার কখনও ধবধবে সাদা। মার্বেল পাথরের ওপর অসাধারণ স্থাপত্যশৈল্পিক কারুকার্য দেখে এক ধরনের বাকরুদ্ধই হয়ে গিয়েছিলাম আমরা।
পরবর্তী গন্তব্য আগ্রা ফোর্ট। মুঘল সম্রাট আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান আর আওরঙ্গজেবের রাজপ্রাসাদ ছিল এখানে। ইতিহাসে পড়া মুঘল রাজত্বের বিশালতা কতটুকু তা আগ্রা ফোর্টে না গেলে বোঝার কোনো সাধ্য নেই। রাজাদের জীবনাচরণ, রাজ্য চালানোর নীতি, তাদের বিলাসিতা যতই দেখছিলাম ততই বিস্ময় ভর করছিল দু’চোখে। মনে হচ্ছিল বইয়ের পাতায় পড়া ইতিহাসের সেই রাজত্বে চলে এসেছি। আগ্রা ফোর্টের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক এর স্থাপত্যশৈলী। আজ থেকে প্রায় পাঁচশ’ বছর আগের যে স্থাপত্যশিল্প এতটা আধুনিক আর বুদ্ধিদীপ্ত ছিল তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করাটা যে কারও জন্যই কঠিন হবে।
আগ্রা ফোর্টের পর আমাদের পরবর্তী উদ্দেশ্য পিংকসিটিখ্যাত জয়পুর। পথে যাত্রাবিরতি সম্রাট আকবরের ফতেপুর সিক্রিতে। ফতেপুর সিক্রি পরিদর্শন শেষে সন্ধ্যায় রাজস্থানের রাজধানী জয়পুরে পৌঁছেই যার যার মতো বের হয়ে পড়ি জয়পুর শহর ঘুরতে। রাতের গোলাপি শহর জয়পুরকেই আমাদের কাছে পৃথিবীর অন্যতম মায়াবী শহর মনে হল। জয়পুরের আল হাবিব রেস্টুরেন্টের চিকেন মাসালা সম্ভবত পৃথিবীর অন্যতম সুস্বাদু খাবারের একটি। পরের দিন সকালের গন্তব্য রাজা প্রতাপসিংহ আর রাজা মানসিংহের রাজপ্রাসাদ, যা আম্বার ফোর্ট নামে পরিচিত। পথে পরিদর্শন করলাম জলমহল নামে অসাধারণ এক স্থাপত্য। অপরূপ কারুকার্য আর সুনিপুণ স্থাপত্যশৈলীর আম্বার ফোর্ট দেখে আবারও সবার চোখে-মুখে বিস্ময়। ভ্রমণ গাইডদের দেয়া এক একটা তথ্য আমাদের কাছে জীবন্তরূপে ধরা দেয়া ইতিহাস বলে মনে হচ্ছিল।
আম্বার ফোর্টে মুগ্ধতার রেশ কাটতে না কাটতেই চলে যাই যন্তর-মন্তর নামের এক বিজ্ঞানের রাজ্যে। এখানে জ্যোতির্বিজ্ঞানের সব বিস্ময় জাগানিয়া আবিষ্কার দেখে মুগ্ধ হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। বিশাল বিশাল সব সূর্য ঘড়ি, কম্পাস, রাশি গণনার যন্ত্র দেখলেই বোঝা যায় অতীতে ভারতবর্ষ জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাতে ছিল কতটা সমৃদ্ধ। এখানে উপমহাদেশের বিখ্যাত সিনেমা হল ‘রাজমন্দির’-এ সিনেমা দেখাটা ছিল অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা। আলবার্ট হল মিউজিয়াম, হাওয়া মহল পরিদর্শন শেষে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য নির্ধারণ করা হল হিমাচল প্রদেশের রাজধানী সিমলা।
জয়পুর থেকে ট্রেনে করে চণ্ডিগড় তারপর জিপে করে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা, উঁচুনিচু পথ ধরে ছুটে চলি সিমলার পথে। রোমাঞ্চকর যাত্রা শেষে যখন সিমলায় পৌঁছালাম সবার চক্ষুই তখন চড়কগাছ। একটা শহর এতটা পরিচ্ছন্ন ও সাজানো কীভাবে হতে পারে! স্রষ্টা প্রকৃতির সব সৌন্দর্যই যেন এখানে ঢেলে দিয়েছেন। রাতে সিমলার বিখ্যাত হোটেল গুলমার্গে রাত যাপন শেষে গ্রিনভ্যালির মনোরম দৃশ্য আর কুফরি পর্যটন কেন্দ্রে অশ্বারোহণের এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিয়ে পরদিন মানালীর উদ্দেশে হোটেল ত্যাগ করি। লক্ষ্য করলাম বন্ধু এবং সহপাঠী সবার মধ্যেই তখন সিমলা ছেড়ে যাওয়ার হতাশা বিরাজ করছে। তখন যাত্রাপথের ঘুমই আমাদের সিমলা ছাড়ার বিরহকে ভুলিয়ে দিল।
ঘুম থেকে জেগে চোখ খুলতেই আবিষ্কার করি নতুন জায়গা। পথের দুই ধারে পাহাড়ি সৌন্দর্য আর পিয়াসী নদীর রূপমাধুর্য। পাহাড়ি রাস্তার রূপলাবণ্য উপভোগ করতে করতে কখন যে মানালী চলে এসেছি টেরই পাইনি।
মানালিতে আমাদের স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষা করছিল মাইনাস ৭ ডিগ্রি তাপমাত্রা সঙ্গে হিমেল হাওয়া। শীতে জবুথবু হয়ে কোনোরকম রাতটা কাটিয়েই পরদিন সকালে বরফের রাজ্য গোলাববাগের উদ্দেশে যাত্রা। বিশাল বিশাল পাহাড়ের গায়ে সাদা বরফ তার ওপর সূর্যের আলো পড়ে যখন চিকচিক করছিল তখন মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যটিই আমরা দেখছি। বিদেশের মাটিতে দীর্ঘদিনের ভ্রমণ শেষে যখন বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে নিজের মাতৃভূমির মাটিতে পা রাখলাম তখন মনের অজান্তেই গেয়ে উঠলাম ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা।
লেখক : মাহমুদুল হাসান
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, (পঞ্চম ব্যাচ)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Post a Comment